পবিত্র রমজানেও যাত্রীদের ভোগান্তি
- মাহমুদুল হাসান
- ২৯ মে ২০১৮, ০০:০০
রাজধানীজুড়ে বাস ও মিনিবাস চলাচলের রুট প্রতি মাসেই বাড়ছে। এসব রুটে নতুন বাসও নামছে। কিন্তÍ কোনোভাবেই কমছে না যাত্রী ভোগান্তি। কারণ, যাত্রীর তুলনায় বাস-মিনিবাস এখনো কম। এ কারণেই রাজধানীর স্টপেজগুলোতে দৌড়-ঝাঁপ দিয়ে নারী, পুরুষ ও শিশুদের বাসে উঠতে দেখা যায়। রমজান মাসে এই ভোগান্তি প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। লিখেছেন মাহমুদুল হাসান
রাজধানীতে সিটিং সার্ভিসের নামে ৯৬ শতাংশ বাস চলছে দরজা বন্ধ করে। আসনের অতিরিক্ত যাত্রীও তোলা হচ্ছে। অথচ, ভাড়া নেওয়া হচ্ছে অতিরিক্ত। আর ৬২ শতাংশ যাত্রী বাস চলা অবস্থায় ওঠা-নামা করতে বাধ্য হচ্ছে।
রমজান মাসে যাত্রীদের ভোগান্তি নিয়ে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি পরিচালিত এক জরিপে এমন চিত্র উঠে এসেছে। জরিপে বলা হচ্ছে, মিটারের বদলে ৯৪ শতাংশ সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলছে চুক্তিতে। ফলে পবিত্র রমজানও যাত্রীদের চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে।
জরিপে দেখা গেছে, গণপরিবহনে চলছে চরম নৈরাজ্য। জরিপে অংশ নেওয়া ৯২ শতাংশ যাত্রী বলেছেন, প্রতিদিন যাতায়াতের ক্ষেত্রে তাদের দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে। যাত্রীদের ভোগান্তি নিরসনে মালিক সমিতি বা সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষের কোনো তৎপরতা জরিপকালে দেখতে পায়নি যাত্রী কল্যাণ সমিতি।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির গণপরিবহনের ভাড়া নৈরাজ্য পর্যবেক্ষণ উপকমিটির পাঁচটি দল ১৯ থেকে ২৪ মে পর্যন্ত ৬ দিন রাজধানীর ১৩টি জায়গায় যাত্রীদের ভোগান্তি ও ভাড়া নৈরাজ্য পর্যবেক্ষণ করে। এ সময় ৩১০টি বাস এবং ২১৪টি অটোরিকশার ভাড়ার তথ্য সংগ্রহ করা হয়। ৫৫৭ জন বাসযাত্রী, ১৮৫ জন অটোরিকশা যাত্রী, ৫৬ জন ট্যাক্সি ক্যাব যাত্রীর সঙ্গে কথা বলেন জরিপকারীরা। জরিপের জায়গাগুলো হলো শনির আখড়া, গুলিস্তান, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, পোস্তগোলা, শাহবাগ, ফার্মগেট, মিরপুর-১০, মহাখালী, আগারগাঁও, ধানমন্ডি, বনানী ও বারিধারা।
জরিপে দেখা যায়, অফিস যাওয়া এবং অফিস ছুটি শেষে ইফতারকে কেন্দ্র করে যাত্রীদের ঘরমুখী যাত্রার সুযোগ নিয়ে বেসরকারি বেশির ভাগ লোকাল বাস রাতারাতি সিটিং সার্ভিস হয়ে গেছে। কিন্তু সিটিং সার্ভিসের নামে অতিরিক্ত ভাড়া দিয়েও ২৮ শতাংশ যাত্রী দাঁড়িয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে। ৯৮ শতাংশ বাসযাত্রী অতিরিক্ত ভাড়া দিতে বাধ্য হচ্ছে। আর ৬২ শতাংশ যাত্রী চলন্ত বাসে ওঠানামা করতে বাধ্য হয়।
অন্য দিকে, নগরে চলাচলকারী সিএনজিচালিত অটোরিকশায় চলছে চালকদের আধিপত্য। জরিপে দেখা যায়, ৯৮ শতাংশ অটোরিকশাচালক মিটারের অতিরিক্ত ভাড়া বা বকশিশ দাবি করছেন। আগে ১০ থেকে ২০ টাকা বকশিশ চাইলেও রমজানে চালকেরা ৩০ থেকে ৫০ টাকা বকশিশ দাবি করছেন। অতিরিক্ত ভাড়া নিলেও যাত্রীদের পছন্দের গন্তব্যে যেতে রাজি হন না ৯০ শতাংশ চালক।
জরিপকারীরা দেখা গেছে, নগরে প্রয়োজনীয় যাত্রীছাউনি না থাকায় এবং যাত্রীছাউনিগুলো বেদখলে থাকায় বৃষ্টিতে নাজুক পরিস্থিতিতে পড়ছে যাত্রীরা, বিশেষ করে নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও অসুস্থ রোগীরা। গণপরিবহনের নৈরাজ্যের মধ্যে পাঠাও, উবারসহ অ্যাপসভিত্তিক পরিবহনগুলো যাত্রীদের কিছুটা স্বস্তি দিচ্ছে।
রমজানেও গণপরিবহনে এমন নৈরাজ্যে যাত্রীরা তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তবে হেনস্তার শিকার হলেও কোথায় অভিযোগ করতে হয়, সেটি জানেন না ৯৩ শতাংশ যাত্রী। আর ৮৮ শতাংশ যাত্রী মনে করেন অভিযোগ করে কোনো প্রতিকার পাওয়া যায় না। যাত্রী ভোগান্তির বিষয়টি গণমাধ্যমে গুরুত্ব পেলেও তা নিরসনে মালিক সমিতি এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষের কোনো তৎপরতা জরিপকারীরা দেখতে পাননি। অধিকাংশ গাড়িই যাত্রি গাড়িতে ওঠার সাথে সাথে ভাড়া নিয়ে নিচ্ছে। অথচ যাত্রীকে একই জায়গায় বসে থাকতে হচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এর ফলে সময় ছাড়াও আর্থিক খতি হচ্ছে প্রতিনিয়ত। অবাক করার বিষয় হলো যানজটের কারণে ব্যস্ত সময়ে রাজধানীতে গণপরিবহনের গতি এখন ঘণ্টায় গড়ে ৫ কিলোমিটারে এসে ঠেকেছে। অন্য দিকে একজন মানুষের হাঁটার গতিও গড়ে ৫ কিলোমিটার। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) করা গবেষণায় এই তথ্য উঠে এসেছে। এ অবস্থায় রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী বাদে অন্য কাউকে সড়কে বিশেষ সুবিধা না দেয়ার প্রস্তাব করেছেন এআরআইয়ের পরিচালক অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন।
যানজট ও সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে করা গবেষণায় এই অধ্যাপক দেখিয়েছেন, রাস্তায় কাউকে একবার বিশেষ সুবিধা দেওয়া হলে এর প্রভাব পরিবহনব্যবস্থায় প্রায় দুই ঘণ্টা পর্যন্ত থাকে। গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশকে কেন্দ্র করে গত শনিবার সকালে এআরআই ভবনে এআরআই এবং রোড সেফটি ফাউন্ডেশন গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। এর শিরোনাম ছিল ‘গণপরিবহনব্যবস্থায় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা এবং যানজট নিরসনের পরিকল্পনা রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহারে অন্তর্ভুক্তি ও বাস্তবায়নে অঙ্গীকার’।
‘মিটিগেটিং ট্রাফিক কনজেশন ইন ঢাকা : অ্যাপ্রোপ্রিয়েট পলিটিক্যাল অ্যাজেন্ডা’ (ঢাকার যানজট কমানো : কার্যকর রাজনৈতিক কর্মসূচি) শিরোনামে গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, যানজটের কারণে ঢাকায় প্রতিদিন ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। এতে বছরে ৩৭ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে।
গবেষক মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, রাজধানীর যানজট যদি ৬০ শতাংশ কমানো যায়, তাহলে বছরে ২২ হাজার কোটি টাকা বাঁচানো যাবে। তিনি বলেন, যানবাহনচালকদের চাকরির নিশ্চয়তা নেই। একটানা তিন দিন যানবাহন চালালেও বিশ্রামের ব্যবস্থা নেই। ফলে চালকদের মেজাজ রুক্ষ থাকে। অব্যবস্থাপনা তাদের ঘাতকে পরিণত করছে। তিনি বলেন, শহরের মোট দুর্ঘটনার ৭৪ শতাংশের শিকার পথচারীরা।
বুয়েটের এআরআইয়ের পরিচালক অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন তার গবেষণায় দেখান, ভারতের মুম্বাই শহরে একটি সংস্থার অধীনে তিন হাজার ৬০০ বাস দিনে ৪৮ লাখ যাতায়াত (ট্রিপ) হয়। যানজটও তুলনামূলক কম। সব দায়-দায়িত্ব সেখানকার মুখ্যমন্ত্রীর। আর ঢাকায় ছয় হাজার বাসে ৩০ লাখ যাতায়াত হয়। শত শত মালিক। নিয়ন্ত্রকও অনেক। এ অবস্থার উন্নয়নে একটি মাত্র নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান থাকার পক্ষে মত দেন অধ্যাপক মোয়াজ্জেম। এ ছাড়া পরিবহন খাতে ভর্তুকির পরামর্শ দেন তিনি।
গোলটেবিলে বৈঠকে সরকারের পরিবহন সংস্থা বিআরটিসির পরিচালক (টেকনিক্যাল) মাহবুবুর রহমান বলেন, ৪০ হাজার চালককে প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য একটা প্রকল্প নিয়েছেন তারা।
রাজনীতি ঠিক না হলে কোনো কিছু ঠিক হবে না বলে গোলটেবিলে মন্তব্য করেন নিরাপদ সড়ক চাইয়ের প্রতিষ্ঠাতা ইলিয়াস কাঞ্চন। তিনি বলেন, দুর্ঘটনায় মানুষ মরছে। কিন্তু দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা দায় নিচ্ছেন না।
নির্বাচনী ইশতেহারে অন্তর্ভুক্তি ও বাস্তবায়নে অঙ্গীকার নিয়ে এই গোলটেবিলের আয়োজন করা হলেও আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির কোনো প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন না।
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘বাসের চাপায় মানুষ মারা যাচ্ছে। সরকারে নেতারা বলছে, আমরা কি বাস চালাই? হাত-পা বাইরে কেন? পথচারীরা তো আইন মানছে না? আমরা সমুদ্র ও মহাকাশ জয় করেছি, এটা অর্জন। কিন্তু ফুটপাত ও সড়ক জয় করতে পারছি না।’
প্রধান দুটি দলের নেতাদের কেউ না থাকার বিষয়টিকে ইঙ্গিত করে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি কাদের সিদ্দিকী বলেন, ‘আজকে যারা বড় আছে, কালকে তারা নাও থাকতে পারে।’
গণপরিবহন খাতের বিশৃঙ্খলার উদাহরণ দিয়ে গণফোরামের নেতা সুব্রত চৌধুরী বলেন, আদালতের রায়ে চালকের শাস্তি হওয়ার পর এক মন্ত্রী তার বাসভবন থেকে আইন অমান্য করার সিদ্ধান্ত নেন।
যানজটে ব্যয় বাড়ছে
রাজধানীর সড়কগুলোতে যাত্রী ও পণ্যবাহী গাড়ি বেড়ে যাওয়ার ফলে যানজট প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এর ফলে পরিবহন খরচ ও অন্যান্য ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীরা। গত শনিবার রাজধানীর মতিঝিলে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের মিনিস্ট্রি অব লোকাল গভর্নমেন্ট, রুরাল ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কো-অপারেটিভস (সিটি করপোরেশন) বিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটির সভায় তারা এই উদ্বেগের কথা প্রকাশ করেন।
কমিটির চেয়ারম্যান মো. হেলাল উদ্দিনের সভাপতিত্বে এতে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন এফবিসিসিআই সহসভাপতি মো. মুনতাকিম আশরাফ, পরিচালক হাফেজ হারুণ অর রশিদ, স্ট্যান্ডিং কমিটির ডাইরেক্টর ইনচার্জ আবু মোতালেব প্রমুখ।
এ সময় বক্তারা বলেন, যানজটের ফলে কর্মঘণ্টা অপচয় এবং ব্যবসা পরিচালনা ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। সড়কে যানের সংখ্যা বাড়ায় পরিবহন খরচ এবং ব্যবসার ব্যয়ও বৃৃদ্ধি পেয়েছে বলে তারা মনে করেন। মহানগরগুলোতে গণপরিবহন সেবা আরো উন্নত করার ওপর গুরুত্ব দেন তারা।
যানজট কি শুধু সময়ই নষ্ট করে যাচ্ছে? শুধু সময়ই নষ্ট করছে, বিষয়টা এমন নয়। সময়ের সঙ্গে যেহেতু সব ধরনের কর্মপরিকল্পনার সম্পর্ক, তাই মানুষের মানসিক চাপ বাড়ছে, কর্মপরিকল্পনা ব্যাহত হচ্ছে, অপরিমেয় আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। যতই দিন যাচ্ছে, ঢাকার রাস্তায় যানজট নিজের সম্প্রসারিত রূপ ও বহুমুখী সমস্যার মাত্রা বাড়িয়েই চলেছে। এককথায় ঢাকার যানজট এখন মানুষের কর্মপরিকল্পনা এবং সময় নষ্টেই সীমাবদ্ধ নেই- আক্রান্ত করছে মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য; আক্রান্ত করছে ব্যবসা-বাণিজ্য তথা সার্বিক অর্থনীতিকে।
মানুষের আবেগ, মনমেজাজ এবং সুখ-অসুখকে প্রভাবিত করছে। বলা হচ্ছে, যানজট বহুমুখী চাপ সৃষ্টিকারী বিধায় এর কারণে মানুষের শরীরে নানাবিধ জটিল রোগ সৃষ্টি হচ্ছে।